বাংলায় একটা প্রবাদ বাক্য আছে – খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। আসন্ন নির্বাচনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে দিয়ে ঘটা করে রাজ্য বিজেপির ইস্তাহার প্রকাশটাও ঠিক সেরকম। পাহাড়প্রমাণ প্রতিশ্রুতি। বিরাট বিরাট আশ্বাস। যেন ‘সোনার বাংলা’র উপকরণ থালায় সাজানো। ক্ষমতায় এলেই রাজ্যবাসীকে সার্ভ করবে মোদী-শাহ। ‘বুলেট ট্রেনে’র গতিতে ঘুরবে ‘ডবল ইঞ্জিন’ ট্রেনের চাকা। কি নেই সেই ইস্তাহারে? নারীর ক্ষমতায়ন থেকে রাজ্যের বেকারত্ব সমস্যার দূরীকরণ, প্রাথমিক থেকে স্মাতকোত্তর পর্যন্ত সকল ছাত্রীকে বিনামূল্যে শিক্ষার সুযোগ, বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা, সপ্তম বেতন কমিশন চালু, ৭৫ লক্ষ কৃষককে বছরে ১০ হাজার টাকা, ১৮ বছর হলেই মেয়েদের দু লক্ষ টাকা আর্থিক সহযোগিতা। আরও কত কি! এইসব কিছুই হবে মোদী-শাহের জাদু বলে। পদ্ম চিহ্নে ভোট দেওয়াটাই শুধু ভোটারদের কাজ। আসলে হেনতেন প্রকারণে নীলবাড়ি দখল করাটাই পাখির চোখ গেরুয়া শিবিরের। কারণ পশ্চিমবঙ্গে আজ অবদি পদ্ম ফোটাতে পারেনি গেরুয়া জুটি। তাই একুশে বঙ্গ নির্বাচন মোদীর কাছে প্রেস্টিজ ফাইটও বটে।
কিন্ত সোনার বাংলা গঠনের লক্ষ্যে রাজ্যে বিজেপির এই যে প্রতিশ্রুতির বন্যা তার সার্বিক সুযোগ সুবিধা আদৌ কি পাবে রাজ্যবাসী? শেষ পর্যন্ত ‘আঙুর ফল টক’ হয়ে যাবে নাতো? সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ বিজেপির প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবের বিরাট ফারাক রয়েছে। যা ভাবাচ্ছে রাজ্যবাসীকে। ইস্তেহারে সরকারি চাকরিতে ৩৩ শতাংশ মহিলা সংরক্ষণের কথা বলেছে রাজ্য বিজেপি। অথচ দেশে এমন কোনো বিজেপি শাসত রাজ্যে নেই যেখানে এই সুবিধা রয়েছে। ব্যাতিক্রম নয় কেন্দ্রের চাকরিও। রাজ্যের বেকারত্ব দূরীকরণে রাজ্যের প্রতিটি পরিবারের একজনকে সরকারি চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে বিজেপি। কিন্ত মোদীর জামানাতেই দেশে বেকারত্ব শিখরে পৌঁছেছে। এক বছরে কাজ হারিয়েছেন ১৩ কোটি মানুষ। এমনকি বিজেপি শাসত রাজ্যে ত্রিপুরার বেকারত্ব দূরীকরণে পুরোপুরি ব্যার্থ। সেখানে বেকারত্বের হার (১০ শতাংশ) জাতীয় হার দ্বিগুণ আর বাংলার তিনগুণ।
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে কেন্দ্রের গড়িমসিতে অতিষ্ঠ মতুয়ারা। তাই তড়িঘড়ি করে রাজ্য গেরুয়া শিবিরের ইস্তাহার ঘোষণার সময়, রাজ্যে ক্ষমতায় এলে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই সিএএ কার্যকর করার আশ্বাস দিয়েছেন অমিত শাহ। কিন্তু আসামে সিএএ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই পদ্ম শিবিরের। অথচ দুই রাজ্যেই অনুপ্রবেশ ইস্যু রয়েছে। উল্টে পরোক্ষভাবে ত্রুটিপূর্ণ এনআরসি’র কথা স্বীকার করে নিয়েছে গেরুয়া শিবির। সেই জায়গায় উন্নত এনআরসি চালু করার কথা জানানো হয়েছে আসামের নির্বাচনী ইস্তাহারে।
বাংলাকে দুর্নীতি মুক্ত করতে চিটফান্ড কাণ্ড ও কয়লা দুর্নীতি তদন্তে এসাইটি গঠন করা হবে। এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের অধীনে থাকবে অ্যান্টি কোরাপশান হেল্প লাইন। কিন্তু অমিত শাহের ইস্তাহার ঘোষণার সময় দেখা গেল। দুর্নীতিগ্রস্ত নেতারাই ইস্তাহার প্রকাশের মঞ্চ আলোকিত করছে। সেই সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে, কেন্দ্রীয় সংস্থা সিবিআই – ইডি কি করল? কারণ বাংলায় ভোট এলেই এই দুই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার বঙ্গে আনাগোনা বেড়ে যায়। তাহলে বিগত কয়েক বছর ধরে তদন্ত চালিয়ে কতদূর এগুলো সেই তদন্তের কাজ?
ভারতের ইতিহাসে মোদীর জামানায় প্রথম পেট্রোল ডিজেলের দাম সেঞ্চুরি করেছে। পেট্রোপণ্যের লাগামছাড়া দাম বৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস উঠছে গাড়ি চালকদের। কিন্তু রাজ্য বিজেপির ইস্তাহারে বলা হচ্ছে, অটো ও ট্যাক্সি চালকদের বার্ষিক ৩০০০/৫০০০ টাকা করে দেওয়া হবে। কিন্তু পেট্রোপণ্যের দাম কমানো নিয়ে কোনো সুরাহা নেই ইস্তেহারে। একইভাবে অরোণ্যাঞ্চলে পাট্টা দেওয়ার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিজেপি শাসত রাজ্যেই পাট্টার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে ৫১% থেকে ৬১%। এসটি ব্লকে রেগার কাজ ১০০ দিন থেকে বাড়িয়ে ২০০ দিন করার কথা বলা হয়েছে। যা কোনো বিজেপি শাসত রাজ্যে আজ অবদি হয়নি। উল্টে রেগায় বরাদ্দ ছাঁটাই করেছে কেন্দ্র নিজে। এমনকি ইস্তেহারে সার্বজনীন পিডিএসের কথা বলা হলেও কেন্দ্রই রেশন গ্রাহকের সংখ্যা কমানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। শরণার্থী পরিবারকে ৫ বছরের জন্য বার্ষিক ১০,০০০ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে গেরুয়া শিবির। কিন্তু দেখা যাচ্ছে উদ্বাস্তু কলোনির স্বীকৃতি পড়ে আছে। কেন্দ্রই পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী প্যাকেজ দেয়নি।
দিল্লীর সিঙঘু সীমান্তে নয়া কৃষি আইন নিয়ে আন্দোলন করছেন কৃষকরা। এমএসপি বাধ্যতামূলক করা নিয়ে কোনো হেলদোল নিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের। অথচ রাজ্য বিজেপির ইস্তাহারে ফসলের দাম নিশ্চিত করার আশ্বাস দিচ্ছে বিজেপি। দেশের একের পর এক বিমানবন্দরকে যখন বেচে দিচ্ছে বিজেপি সরকার। সেখানে বাগডোগরা বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক করার ও কোচবিহারে বিমানবন্দর তৈরীর কথা বলছে বিজেপি। এমনকি বামফ্রন্ট সরকারের সময়েই তৈরী হয়েছিল উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন পর্ষদ। তাকেই ফের একুশের নির্বাচনী ইস্তাহারে যোগ করেছে পদ্ম শিবির।
তাই ‘সোনার বাংলা’ গঠনের লক্ষ্যে বিজেপি ইস্তাহারে প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবের ফারাক বিস্তর। সবটাই খালি কলসি মতো। বাংলার একটা প্রবাদ বাক্য দিয়েই শেষ করবো – যে যত গরজায় সে তত বর্ষায় না।